Header Ads

বাংলাদেশে আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা: বাস্তবতা বনাম তাত্ত্বিক ধারণা

 

প্রতিটি দেশেই আমলাতন্ত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় অঙ্গ। সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে দক্ষ ও পেশাদার আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অপরিহার্য। তবে বর্তমান আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি, দক্ষতার অভাব এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার ঘাটতি প্রভৃতি সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনও বিকল্প নাই। তবে এর জন্য ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এ প্রবন্ধে তত্ত্বের আলোকে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সংস্কারের প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

সমাজবিজ্ঞানী ম্যাক্স ওয়েবার আধুনিক সমাজে আমলাতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার মতে, একটি আদর্শ আমলাতন্ত্রের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে নিদেনপক্ষে কতিপয় বৈশিষ্ট্য থাকা জরুরি। ওয়েবারের মতে, আদর্শ আমলাতন্ত্রের ভিত্তি হলো আইনের শাসন এবং কর্তৃত্বের বৈধতা (Legal-Rational Authority)। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কর্তৃত্বের এই বৈধতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে অনেক সময় এই বৈধতা ব্যাহত হয়। ক্ষমতা প্রয়োগ এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করা হয়। ওয়েবারের তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে ‘লিগ্যাল-রেশনাল অথরিটি’ প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে প্রশাসন পরিচালনার একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে সব কর্মকাণ্ড নির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর অধীনে পরিচালিত হবে। পাশাপাশি, যোগ্যতা ও মেধার (Meritocracy) ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। তিনি দেখিয়েছেন, আমলাতন্ত্রে ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সংযোগের চেয়ে দক্ষতা, মেধা, এবং পেশাদারিত্ব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক আনুগত্য বা ব্যক্তিগত সংযোগের প্রভাব লক্ষ করা যায়, যা আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে একটি বড় বাধা। একটি যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হলে, প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কর্মকর্তাদের নির্বাচন করতে হবে। ওয়েবারের তত্ত্ব অনুসারে, যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ এবং পদোন্নতি ব্যবস্থা আমলাতন্ত্রে পেশাদারিত্ব এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রশাসনের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া ওয়েবার আমলাতন্ত্রকে একটি কাঠামোগত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন, যেখানে প্রতিটি স্তরের কাজ এবং দায়িত্ব স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকে (Formalized Rules and Role Clarity)। এবং প্রতিটি কর্মকর্তা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দায়িত্বের স্পষ্টতা অনেক ক্ষেত্রে অভাব দেখা যায়। কাজের দায়িত্ব এবং আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার অভাবে প্রশাসনিক কার্যক্রমে সমন্বয়ের অভাব সৃষ্টি হয়।

ওয়েবারের আদর্শ অনুসারে, আমলাতন্ত্রের প্রতিটি স্তরে কাজের বিভাজন এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা স্পষ্ট থাকলে, প্রশাসনিক কার্যক্রম আরও সমন্বিত ও কার্যকর হতে পারে। ওয়েবারের তত্ত্বে পেশাদারিত্ব এবং নিরপেক্ষতা (Impersonality and Professionalism) বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, আদর্শ আমলাতন্ত্রে কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব বা রাজনৈতিক আনুগত্যের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রতি দায়বদ্ধ হতে হবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনেক সময় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেন না। ওয়েবারের নিরপেক্ষতা তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রকে পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হলে প্রশাসনিক কর্মচারীদের রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্বমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে।

অন্যদিকে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন তার ‘Political Order in Changing Societies’ গ্রন্থে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তার মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা এবং প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হলে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ে। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার প্রাসঙ্গিকতা হান্টিংটনের তত্ত্বের মাধ্যমে স্পষ্ট করা যায়। পাশাপাশি হান্টিংটনের মতে, একটি দেশের উন্নয়ন এবং শাসন ব্যবস্থার স্থিতিশীলতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ (Institutionalization) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ প্রক্রিয়া এখনও শক্তিশালী হয়নি। প্রশাসনিক কাঠামোতে রাজনৈতিক প্রভাব এবং অনিয়মের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওয়েবারের মতো হান্টিংটনও মনে করেন, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম এবং নীতির প্রতি আনুগত্য ছাড়া রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হতে পারে। সেই সঙ্গে হান্টিংটন দেখিয়েছেন, রাজনৈতিক শৃঙ্খলা (Political Order) ছাড়া কোনও সমাজ দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল থাকতে পারে না। প্রশাসনিক কাঠামো যদি শক্তিশালী না হয়, তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি এবং সমাজের মধ্যে অসমতা বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা অনেক সময় সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, যা উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। হান্টিংটনের তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে, যেখানে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো সুষ্ঠুভাবে কাজ করবে। অধিকন্তু হান্টিংটনের তত্ত্বে সুশাসনের (Governance Efficiency) গুরুত্ব অপরিসীম। তার মতে, একটি রাষ্ট্রের প্রশাসন যদি সুষ্ঠুভাবে কাজ না করে তবে তা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুশাসনের অভাব অনেক সমস্যার জন্ম দিয়েছে। প্রশাসনের দুর্নীতি, দায়িত্বহীনতা এবং স্বচ্ছতার অভাবে সাধারণ মানুষের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

হান্টিংটনের সুশাসনের তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাদেশে আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে প্রশাসনের দক্ষতা এবং সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসবে।বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সংস্কার সংক্রান্ত প্রস্তাব করার পূর্বে বর্তমান বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ এবং তাত্ত্বিক প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে ধারণা থাকা আবশ্যক।  

বাংলাদেশে আমলাতন্ত্রে রাজনৈতিক প্রভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের নিয়োগ এবং পদোন্নতি দেওয়ার প্রবণতা প্রশাসনিক কার্যকারিতা হ্রাস করে। ওয়েবারের তত্ত্ব অনুসারে, যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রক্রিয়া চালু করা গেলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। পাশাপাশি, হান্টিংটনের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

পাশাপাশি, দুর্নীতি বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের একটি প্রধান সমস্যা। সরকারি কার্যক্রমের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং স্বচ্ছতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। ওয়েবারের নিয়ম-শৃঙ্খলা এবং স্বচ্ছতার তত্ত্ব অনুসারে, দুর্নীতির কারণে প্রশাসনিক কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হান্টিংটনের তত্ত্ব অনুযায়ী, সুশাসন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। এছাড়া বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে আধুনিক দক্ষতার অভাব রয়েছে, বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে।

ওয়েবারের কাজের আনুষ্ঠানিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও কাঠামোগত ও দক্ষ করতে হলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। ই-গভর্ন্যান্স এবং আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশাসনের দক্ষতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বাংলাদেশে আদর্শ আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে প্রশাসনের কার্যকারিতা এবং সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব। ম্যাক্স ওয়েবারের তত্ত্ব অনুসারে, যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ, পেশাদারিত্ব এবং নিয়ম-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা হলে আমলাতন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়বে। স্যামুয়েল হান্টিংটনের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ এবং সুশাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই দুই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর আমলাতন্ত্র গড়ে তোলা যেতে পারে, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের পথ সুগম করবে।

লেখক: লোক-প্রশাসন এবং জননীতি গবেষক।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.